Pages

Wednesday, 27 September 2017

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কিছু কথা অথবা জীবনি

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কিছু কথা অথবা জীবনি । 
মজলুম নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ ধানগড়া গ্রামে জম্ম গ্রহণ করেন । আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পিতার নাম শরাফত আলী । তার পিতা অনেক উদার ও আদর্শ মনের একজন ভদ্রলোক ছিলেন । 
আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বয়স যখন ছয় তখন তার পিতা মৃত্যু বরণ করেন । 

আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বয়স এগার হলো তখন তার মা মৃত্যু বরণ করেন ।তার পর থেকে সে তার চাচার অনুগ্রহে মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও লেখা পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা,, গাণ গাওয়া,,বক্তৃতা নকল করা তার এইসব বিভিন্ন গুণের কারনে খুব দ্রুত কিছুগুণগ্রাহী জুটে যায় । 

আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাংগঠনিক প্রতিভা ও ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে মনোভাবে শষ্কিত হয়ে জমিদারদের অত্যাচার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার স্নেহশীল শিক্ষক মাওলানা আব্দুল বাকী আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পাঠিয়ে দেন,পীর সৈয়দ নাসির উদ্দিন বোগদাদীর কাছে আধ্যাত্মিক জীবনের শিক্ষার জন্য ।সেখান থেকে তার আধ্যাত্মিক জীবনে পাঠ্য শুরু হয় । 
আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বাল্য নাম ছিল চেগা মিয়া । 

আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বিংশশতকী ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন ।এবং আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জীবদ্দশায় ১৯৪৭সালে সৃষ্ট পাকিস্তান এবং ১৯৭১সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। 

তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন । এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকাও পালন করেন মাওলানা ভাসানী । 

তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । তার অনুসারীদের অনেকে সেজন্য তাকে লাল মওলানা নামেও ডাকতেন । 

মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো । 

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ওয়ালাকুমুসসালাম বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন ।
 

তিনি ইসালামিক শিক্ষার জন্য ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান । এবং সেখানে তিনি দুই বছর অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন । ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন । ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন মওলানা ভাসানী । 

এর পর ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারেও ভূমিকা পালন করেন । ১৯২৬সালে আসামে প্রথম কৃষক প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাতও ঘটান মওলানা ভাসানী । 

তার পরে তিনি ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন । তখন থেকে তার নাম রাখা হয় ভাসানীর মাওলানা । তারপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয় ।
 


তিনি ১৯৭৬ সালে ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন । তাকে টাংগাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর পশ্চিমে সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয় । সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তার জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছেন । 

১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারীতে ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় কৃষক সম্মেলন করেছেন । ১৯৩৭ সালে মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং একই সাথে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন । সে সময়ে তিনি আসামে লাইন প্রথা চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । 

সেসময় তিনি আসাম চাষী মজুর সমিতি গঠন করেন এবং ধুবরী,, গোয়ালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । ১৯৪০ সালে শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন । ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন । 



১৯৪৫ সাল থেকে ৪৬ সাল পযন্ত আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বাঙ্গাল খেদাও আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয় । সেসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা,, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা সফর করেন । তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন । ১৯৪৮সালে মুক্তি পান । তারপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন । 
১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন । ১৯৪৮সালে মার্চের ১৭তারিখে ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন । 


১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে । 

এখানে উলেস্নখ যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । 

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা । মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন । 

পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন । বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ এবং ২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্ববান করলেন । 


২৩ জুন ও কর্মি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মী সে সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন । সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান । মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি । ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয় । মওলানা ভাসানী সর্ব সম্মতি ক্রমে এই দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন । 

সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল । ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয় । ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল । 

এবং ঐ জন সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারনে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান । 

১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হওয়া এক জনসভা আর সে সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়েছিল । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে মওলানা ভাসানী ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হয়েছেন । অবশ্য সে জন্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল । 

পূর্ব বাঙলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেলেন ।এবং সে নির্বাচনের যুক্তফ্রন্টে বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন । 


ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে যান এবং সেখানে বক্তব্য রাখেন । ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন । 

১১ মাস লন্ডন,, বার্লিন,, দিল্লী এবং কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এর পর তিনি ১৯৫৫ সালের ২৫ শে এপ্রিল দেশে ফিরে আছেন । পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬ সালের ৭ই মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেলেন । 

সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪শে মে অনশন ভঙ্গ করেন । একই বছরে ১২ই সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয় । 

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল,,এবং তখন মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন ৷ 


অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন,, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে । এছাড়াও কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক ও মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন । 

প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলেন এবং ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন । একই বছর ২৫শে জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ গঠিত হয় । ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি । 

১৯৫৭ সালের ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।এবং ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হলো । ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকলেন মওলানা ভাসানী । 

বন্দী অবস্থায় ১৯৬২সালের ২৬শে অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য এবং পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করলেন তারা । ৩রা নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হলেন । 

১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। ঠিক এই একই বছর ২৪শে সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবসের উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন মওলানা ভাসানী । ১৯৬৪সালে ২৯শে ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামীলিগ পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১শে জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল কপ গঠনে ভূমিকা পালন করেন । 

১৯৬৫সালের ১৭ই জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন ।এবং ১৯৬৬সালে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন । ১৯৬৭ সালে ২২শে জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন । 

১৯৬৭সালে নভেম্বর মাসে ন্যাপ দ্বি খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন।এবং ১৯৬৯সালের ৮ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন । 

২৬শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন । আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই,, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করা হয় । 


কাগমারী সম্মেলনও ১৯৫৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।আর ৮ই ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে তা আরম্ভ হয়েছিল । 

এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা দিয়েছিলেন । বক্তৃতায় 
১৯৭০ সালের ৬ ও ৮ই আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করা হয় । তারপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রান ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালেনন । 

এবং ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি উত্থাপন করলেন । ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানালেন । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেন । 

২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন । সে পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে গেলেন । পাকিস্তান বাহিনী তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দিলেন । তার পর মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হয় । 

সর্বশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী এবং সাইফুল ইসলাম ১৫ই এবং ১৬ই এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হলেন । তারপরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হলো । এরপর মওলানা ভাসানী এবং সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । 


এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫ম তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়েছিল । ১৯৭১ সালের ২৩শে এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল । 
তাছাড়াও মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং,, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছেন । সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে,, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন । 


উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বববান জানান । ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেনন । 

৩১ মে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার পাক বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত । তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর । তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই । ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ কয়েক লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে ।
 

এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুইবার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হলেন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন । 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী । ঐ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন ১। তাজউদ্দীন আহমদ ২। মণি সিংহ ৩। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ৪। মনোরঞ্জন ধর । মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঐ উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছিল যে পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না । 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন,, দিল্লী এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেছেন । পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন । ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন । তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল । 

ভারত সরকার গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি প্রদানের পর মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন । ১৯৭২সালে ২৫শে ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক কথা প্রকাশ করা হয় । বাংলাদেশ ও ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলে মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন । 

১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫ই এবং ২২শে মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন । ১৯৭৪ সালের ৮ই এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন । এবং এই একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন । ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ফারাক্কা বাধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দিলেন । ও একই বছর ২রা অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। 

রাজনীতির পাশাপাশি মওলানা ভাসানী সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িতও ছিলেন । জয়পুরহাট এর পাঁচবিবিতে মহিপুর হাজী মহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি । তার পরে সেটি জাতীয়করণ করা হয় । আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও মওলানা ভাসানী কারিগরী শিক্ষা কলেজ,, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন । তাছাড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ ও পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন । 




তথ্যসূত্র> সিরাজুল হোসেন খান,, উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত,, ঢাকা ।

No comments:

Post a Comment