Pages

Showing posts with label ক্ষুদ্র ব্যবসা. Show all posts
Showing posts with label ক্ষুদ্র ব্যবসা. Show all posts

Tuesday 10 October 2017

বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার পরিকল্পনা

আমাদের দেশে প্রাণীজ আমিষের অভাব খুবই প্রকট। আমিষের এ অভাব মেটাতে মুরগি পালনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান বিশেষ জরুরী। খুব অল্প সময়ে অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে সাম্প্রতিক সময়ে মুরগি পালন একটি লাভজনক ও সম্ভাবনাময় কৃষি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক পরিকল্পনায় মুরগি খামার স্থাপনের মাধ্যমে মুরগি পালনকে লাভজনক করে তোলা যায়। মুরগি খামার দু’ধরনের হতে পারে। যেমন-পারিবারিক মুরগি খামার ও বাণিজ্যিক মুরগি খামার। পারিবারিক মুরগি খামারে অল্পসংখ্যক মুরগি পালন করে সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে বাণিজ্যিক মুরগি খামার গড়ে তোলা যায়। উৎপাদনের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে মুরগির খামার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। মাংস উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন করলে একে বলা হয় ব্রয়লার খামার। আবার ডিম উৎপাদনের জন্য খামার করলে একে বলা হয় লেয়ার খামার। তবে যে খামারই স্থাপন করা হোক না কেন তা লাভজনক করতে চাইলে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিচালনা।

বাণিজ্যিক মুরগি খামারের জন্য স্থান নির্বাচন

মুরগির খামার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। খামার বলতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মুরগি প্রতিপালন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানকে বুঝায়। মুরগির খামার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন ডিম উৎপাদন খামার, মাংস উৎপাদন খামার, প্রজনন খামার, ব্রিডার খামার, বাচ্চা উৎপাদন খামার ইত্যাদি। যে ধরনের মুরগি খামারই স্থাপন করা হোক না কেন সাফল্যজনকভাবে খামার পরিচালনার জন্য এর স্থান নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কৌশল। খামারের জন্য স্থান নির্বাচনের সময় নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন-
  • খামারের স্থান উঁচু হওয়া উচিত। খামার এমন স্থানে গড়তে হবে যেখানে বন্যার পানি কখনও প্রবেশ করতে না পারে।
  • যে স্থানে খামার করা হবে সেখানকার মাটি বালু ও কাঁকর মিশ্রিত হতে হবে এবং মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা থাকতে হবে।
  • খামার স্থাপনের জন্য নির্বাচিত স্থানে পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • খামারের স্থানটি মানুষের বাড়িঘর থেকে দূরে কোলাহলমুক্ত জায়গায় হতে হবে।
  • যে স্থানে খামার করা হবে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে। মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত মূলপথ থেকে অন্তত আধা কিলোমিটার দুরে খামারের স্থান নির্বাচন করা উচিত।
  • যেখানে খামার করা হবে সেখানে বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • খামারের স্থান নির্বাচনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আশেপাশে সস্তায় ও সহজে মুরগির খাদ্য ক্রয় করার সুযোগ-সুবিধা থাকে।
  • খামারে উৎপাদিত পণ্য, যেমন-ডিম, মুরগি ইত্যাদি সহজে বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকতে হবে।
  • খামার স্থাপনের জন্য নির্বাচিত স্থানের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম কি না সেটাও বিবেচনা করতে হবে।

বাণিজ্যিক মুরগি খামার পরিকল্পনায় বিবেচ্য বিষয়সমূহ

যে কোন খামার বা শিল্পে বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভের জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাণিজ্যিক মুরগি খামার ব্যবস্থাপনায় তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়, যথা-
  • মুরগির খাদ্য
  • বাসস্থান ও
  • রোগ দমন। মুরগির খামার একটি বিশেষ ধরনের শিল্প।
তাই এ খামার প্রতিষ্ঠার জন্য মূল বিষয় ছাড়াও আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হয়। মুরগির খামার পরিকল্পনার সময় নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
জমির পরিমাণ
বার্ষিক যত সংখ্যক ডিম/ব্রয়লার উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে তদনুযায়ী লেয়ার/ব্রয়লার প্রতিপালনের ঘর এবং অন্যান্য সুবিধা, যেমন- অফিস, শ্রমিক ঘর, খাদ্য গুদাম, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের ঘর, সংরক্ষণাগার ইত্যাদি তৈরির জন্য মোট জায়গার সঙ্গে আরও প্রায় ১.৫ গুণ ফাঁকা জায়গা যুক্ত করে খামারের মোট জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
মুরগির বাসস্থান
নিরাপদ ও আরামে থাকার জায়গার নাম বাসস্থান। বাসস্থান নিরাপদ রাখতে হলে নির্বাচিত স্থানের উপযোগী দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে তা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ঝড়বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে সহজে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। বাসস্থানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, যেমন-পরিমাণমতো থাকার জায়গা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য ও পানির পাত্র, তাপ ও আলো এবং বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। পালনকারীর সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে ঘর পাকা, কাঁচা বা টিনের হতে পারে। প্রজাতি বা স্ট্রেইন অনুযায়ী যতগুলো মুরগি রাখা হবে এদের মোট জায়গার পরিমাণ হিসেব করে ঘর তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুইটি ঘরের মাঝে ২৫-৩০ ফুট বা ততোধিক জায়গা আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবাহের জন্য খালি রাখা দরকার।
  • ঘর তৈরিঃ বাজারজাত করার বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য ১ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। এভাবে হিসেব করে ব্রয়লার উৎপাদনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই ঘরের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। সাদা খোসার ডিম উৎপাদনকারী প্রতিটি মুরগির জন্য ৩ বর্গফুট জায়গা এবং বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য ৪ বর্গফুট জায়গা হিসেব করে থাকার ঘর তৈরি করতে হবে। এসব মুরগি খাঁচায়, মাচায় অথবা লিটার পদ্ধতিতে পালন করা যায়। পালন পদ্ধতির উপর নির্ভর করে ঘরের পরিমাণ ভিন্ন ধরনের হতে পারে। খাঁচা পদ্ধতিতে প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য কেইজে ৬০-৭০ বর্গইঞ্চি জায়গা প্রয়োজন হবে। কাজেই এ হিসেবে খাঁচা তৈরি করা হয়। খাঁচার সারি লম্বালম্বিভাবে এক সারি বা একটার উপর আরেকটা রেখে ৩/৪ সারি করা যায়। আবার সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে উভয় পার্শ্বেও সারি করা যায়। প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ মাচায় ১.২-১.৩ বর্গফুট এবং লিটারে ১.৫-১.৭৫ বর্গফুট। মুরগির দৈহিক ওজন এবং আবহাওয়াভেদে এই পরিমাপের পরিবর্তন হতে পারে। লিটার পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতি ১০ বর্গফুট মেঝের জন্য ৫ কেজি লিটার প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে পালন করতে মুরগির ঘরের মেঝে পাকা হলে ভালো হয়। কাঁচা মেঝের ক্ষেত্রে শক্ত এঁটেল মাটির মেঝে হলেও চলবে। তবে এ ধরনের মেঝে বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যেতে পারে। শুকনো বালির মেঝের ক্ষেত্রে বর্ষাকালে সমস্যা হতে পারে।
  • ঘরের চালা ও বেড়ার নমুনাঃ বাংলাদেশের পরিবেশে দোচালা বা গেবল টাইপ চালই মুরগির জন্য বেশি আরামদায়ক। লেয়ারের ঘরের বেড়ার উচ্চতার পুরোটাই তারজালি দিয়ে তৈরি করতে হবে। বেশি বাতাস বা বেশি শীত হতে মুরগিকে রক্ষা করার জন্য বেড়ার ফাঁকা অংশ প্রয়োজনে ঢেকে দেয়ার জন্য চটের পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রয়লার লালন-পালনের সুবিধার্থে প্রথম সপ্তাহে ৯৫০ ফা থেকে কমাতে কমাতে ষষ্ঠ সপ্তাহে ৭০০ ফা-এ নামিয়ে আনার জন্য বেড়ায় বেশি ফাঁকা জায়গা রাখা যাবে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এজন্য দেয়ালের উচ্চতার ৬০% তারজালি দিয়ে তৈরি করতে হয়। তবে শীতের দিনে তারজালির এ অংশটুকু চটের বস্তা দিয়ে ঢাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ডিম পাড়ার বাসাঃ মাচা অথবা লিটারে পালন পদ্ধতিতে প্রতি ৫টি মুরগির জন্য ১টি করে ডিম পাড়ার বাসা সরবরাহ করতে হয়। প্রতিটি বাসা দৈর্ঘ্যে ১ ফুট, প্রস্থে ১ ফুট ও গভীরতায় ১.৫ ফুট হওয়া প্রয়োজন। খাঁচা পদ্ধতিতে পালন করলে আলাদাভাবে ডিম পাড়ার বাসা বা বাক্স লাগে না। খাঁচাগুলো ঢালসহ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে মুরগি ডিম পাড়া মাত্রই ডিমগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে খাঁচার সামনে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরের বর্ধিত অংশ এসে জড়ো হতে পারে।
  • আলোকায়নঃ লেয়ারে দৈনিক (২৪ ঘন্টায়) আলোর প্রয়োজন হবে ১৬ ঘন্টা। কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা বছরের ছোট-বড় দিন অনুযায়ী দৈনিক ২.৫ ঘন্টা হতে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত হবে। আলোর উৎস বৈদ্যুতিক বাল্ব। যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই সেখানে উজ্জ্বল হারিকেনের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্বের শক্তি হবে ৪০ ওয়াট, আলোর রং স্বাভাবিক, আলোর তীব্রতা মৃদু (২০ লাক্স) হবে। ১টি বাল্বের আলোকায়ন এলাকা ১০০০ বর্গ ফুট। বাল্ব স্থাপনের এক পয়েন্ট হতে আরেক পয়েন্টের দূরত্ব হবে ২০ফুট। প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে কোনো উৎস থেকেই ব্রয়লার গৃহে আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রথম সপ্তাহে ব্রয়লার গৃহে খাবার ও পানি দেখার জন্য সারারাত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে আলো নিভিয়ে আবার জ্বালাতে হবে এবং এভাবে সারারাত মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। সাধারণত প্রতি ১০ বর্গফুটের জন্য ৫ ওয়াট পরিমাণ আলো প্রয়োজন।
মুরগির খাদ্য ব্যবস্থাপনা
খাদ্যের গুণগত মান, খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, প্রতি কেজি খাদ্যের দাম, খাদ্য হজমের দক্ষতা প্রভৃতি খাদ্য ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। খাদ্য খরচ মোট উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৬০-৭৫% এবং খাদ্যের গুনাগুণ ও মূল্যের ওপর লাভলোকসান নির্ভর করে। সেজন্য খামার ব্যবস্থাপনায় খাদ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু বাসস্থানের পরিবেশ অনুকূল ও আরামদায়ক না হলে শুধু খাদ্য দিয়ে তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তেমনি খামার রোগমুক্ত না হলেও তা লাভজনক হবে না। তাই খাদ্য সংগ্রহ করা সহজ কি না এবং খাদ্যের মূল্য ন্যায্য কি না তা বিবেচনা করে খামার স্থাপন করতে হবে।
লেয়ার মুরগির সংখ্যা অনুসারে প্রতিটি মুরগির জন্য দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হিসেবে কমপক্ষে ২ মাসের খাদ্য সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হয়। প্রতিটি ব্রয়লার ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ৪ কেজি খাদ্য খাবে। তাই এ পরিমাণকে ব্রয়লারের মোট সংখ্যা দিয়ে গুণ করে যে ফল দাঁড়াবে সে পরিমাণ খাদ্য ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম তৈরি করতে হবে। বয়সভেদে ব্রয়লারের জন্য ২.৫-১০ সেন্টিমিটার লম্বা খাদ্যের পাত্র বা ফিড ট্রাফের প্রয়োজন। সাধারণত ৫০টি বাচ্চার জন্য একটি খাদ্যের লম্বা ট্রে বা পাত্র এবং তদনুযায়ী পানির পাত্র প্রতি ১০০টি বাচ্চার জন্য প্রবহমাণ পানির ১টি ড্রিংকার প্রয়োজন হয়।
মুলধনের অবস্থা কী? নিজের টাকা আছে না কি এসব হিসাব করে ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। মূলধনের উপর ভিত্তি করেই খামার স্থাপনের জমি, বাসস্থানের আকার ও সংখ্যা, প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ অনুসারে গুদামের ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানির পাত্র, ব্র“ডিং যন্ত্রপাতি, খামার পরিচালনার লোকজনের জন্য অফিসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
খামার স্থাপন ও পরিচালনার হিসাব
খামার স্থাপন ও পরিচালনার খরচ দুইভাগে বিভক্ত। যথা-
ক) স্থায়ী খরচঃ স্থায়ী খরচের খাতওয়ারী হিসেব নিম্ন্নরূপ-
খামারভুক্ত জমির মূল্যঃ
এলাকা অনুযায়ী প্রতি বিঘা জমির মুল্য কমবেশি হয়ে থাকে।
মুরগির গৃহায়ণ ব্যবস্থা বাবদ খরচঃ ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যথা-বাঁশ, টিন বা বিচালী, মাটির ঘর, ইট, সিমেন্ট বা পাকা দালান ঘর। ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ঘর তৈরির খরচ, তা যেভাবেই ঘর তৈরি করা হোক না কেন প্রতি বর্গফুট হিসেবে খরচ ধরে ঘরের মোট খরচ বের করতে হবে।
ম্যানেজারের অফিস, ডিম/মাংস সংরক্ষণাগার, খাদ্য গুদাম, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসপত্র রাখার স্থান, শ্রমিকদের বিশ্রাম ঘর, অসুস্থ ও মৃত মুরগি রাখার জায়গা নির্মানবাবদ খরচ।
আসবাবপত্র ক্রয় বা তৈরি ও যানবাহন ক্রয়বাবদ খরচ, খাবার ও পানির পাত্রের দাম, ডিম পাড়ার বাক্সের দাম ও ডিম রাখার ঝুড়ি কেনার জন্য খরচ।
খ) আবর্তক বা চলমান বা চলতি খরচঃ আবর্তক খরচের খাতওয়ারী হিসেব নিম্নরূপ-
মুরগি সংক্রান্ত খরচঃ ডিমের ব্যবহার অনুযায়ী ডিমপাড়া মুরগির খামার দু’প্রকার। যথা-নিষিক্ত বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন খামার এবং অনিষিক্ত বা খাবার ডিম উৎপাদন খামার। খাবার সাদা বা বাদামি খোসার ডিম বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদনকারী মুরগি বা বাচ্চা কোথায় পাবেন, আপনি সেগুলো আনতে পারবেন কি না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে। নিষিক্ত ডিম বা ডিমের জন্য প্রজননক্ষম পুলেট ও ককরেলের মূল্য, অনিষিক্ত বা খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য উন্নতমানের হাইব্রিড পুলেটের মূল্য অথবা একদিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চা ক্রয়ের খরচ।
সুষম খাদ্যের মূল্যঃ
মাথাপিছু দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম হিসাবে।
লিটার কেনাবাবদ খরচ। খাঁচায় মুরগি পালন করলে মেঝে পাকা হলেই ভালো।
প্রতিষেধক টিকা এবং চিকিৎসায় ওষুধপত্রের মূল্য।
খামার পরিচালনায় জনবলের বেতনভাতা খরচ, ম্যানেজারের বার্ষিক বেতনভাতা, অফিস স্টাফের বার্ষিক বেতনভাতা ও শ্রমিকদের বার্ষিক বেতনভাতা।
পরিবহন ও যাতায়াত খরচ, বিভিন্ন কাজে ম্যানেজারের যাতায়াত খরচ এবং খাদ্য সংগ্রহ, ডিম বাজারজাতকরণ ও ডিমপাড়া শেষে মুরগি বিক্রির জন্য পরিবহন খরচ।
মুলধনের সুদঃ ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে মূলধনের উপর বার্ষিক সুদ।
ডিপ্রিসিয়েসন বা অপচয় খরচঃ জমিবাদে স্থায়ী খরচের অপচয়ের শতকরা হার ইত্যাদি যত খরচ হয় সব যোগ করে বার্ষিক খরচ/ মোট খরচের হিসেব রাখতে হবে।
  • মেরামত খরচ এবং বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদ
  • এডভারটাইজিং বা বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয়
  • নষ্ট বা বাদ যাওয়া ডিমের মূল্য, ডিম বাছাই ও ছাঁটাই খরচ, যতগুলো ডিম বিক্রির অনুপযুক্ত হলো তার মূল্য।
  • অসুস্থ বা মৃত মুরগির মূল্য
  • খামার হতে সম্ভাব্য বার্ষিক আয়
ডিম বিক্রিঃ
লেয়ার খামারের ক্ষেত্রে বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে উৎপাদন ধরে বর্তমান বাজার দরে ডিমের মোট মূল্য।
ডিম পাড়া শেষে মুরগির মূল্যঃ
  • শতকরা ৮৮টি মুরগি সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে এ হিসেবে ডিম পাড়া শেষে বাজার দরে মোট মূল্য।
  • ব্রয়লার খামারের ক্ষেত্রে গড়ে ৮ সপ্তাহ পর পর মাংসের জন্য মুরগি বিক্রি।
  • প্রতিটি মুরগি থেকে বছরে প্রায় ৩০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যেতে পারে। এভাবে হিসেব করে বর্তমান বাজার দরে মোট বিষ্ঠা বা সারের মূল্য।
  • অকেজো আসবাবপত্র বিক্রিবাবদ মোট আয়।
খামার হতে বার্ষিক কত টাকা লাভ হতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে। অনুমেয় অর্থ মুনাফা করতে হলে খামারজাত পণ্য হতে শতকরা ১০-১২ হারে টাকা হারে লাভে মোট কত টাকা আয় হতে পারে তা হিসেব করতে হবে। বর্তমান বাজার দরে কতগুলো ডিম বিক্রি করলে এ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করা যায় তা হিসেব করতে হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন-বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে খাবার ডিম বা অনিষিক্ত ডিম উৎপাদন এবং ৬০-৬৫% হারে বাচ্চা ফুটানো বা নিষিক্ত ডিম উৎপাদন ধরে, প্রতিটি ডিম গড়ে ২.৫০-৩.০০ টাকা হিসেবে বিক্রি করা গেলে এবং বছর শেষে ৮৮% মুরগি নীরোগ ও স্বাস্থ্যবান থাকলে আর অবশিষ্ট অনুৎপাদনশীল মুরগি বিক্রি করে ও উৎপাদন খরচ বাদে ১০-১২% লাভ থাকবে। এ জাতীয় হিসেব করে পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবে মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত লাভ-লোকসান নির্ধারণ করতে হবে। উপরোক্ত বিষয়সমূহ ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করা উচিত।
কেস স্টাডি:
পোলট্রি ফার্মে মাহমুদার সংসারে সুখের হাসি
বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে মেঝো মেয়ে মাহমুদা আক্তার। দিনমজুর বাবা কুদু মিয়ার আয়-রোজগার দিয়ে অনেক কষ্টে চলত তাদের ছয় সদস্যের পরিবারটি। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার থানাধীন বালিয়াপাড়া গ্রামে তাদের বসবাস। পড়ালেখা করেছেন গাঁয়ের স্কুলে মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। কুদু মিয়া বড় দুই মেয়েকে সাদামাঠাভাবে বিয়ে দিতে পারলেও মেঝো মেয়ে মাহমুদা আক্তারকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। পিত্রালয় ও স্বামীগৃহ একই গ্রামে। লাল মিয়ার ছেলে মোবারকের সঙ্গে আট বছর আগে বিয়ে হয় মাহমুদার। দেখতে দেখতে চলে যায় বিয়ের আট বছর। অভাব যেন সংসারে আদাজল খেয়ে লেগে আছে। এরই মধ্যে সংসারে আসে ফারুক ও রিতা নামের দুটি সন্তান। এক বছর আগে মাহমুদার রিকশাচালক স্বামী মোবারক মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ায় তার সংসারে ঢুকে অভাবের দানব। স্বামীর মৃত্যুর পর মাঝিবিহীন নৌকার মতো হয়ে পড়ে তার সংসার। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া তো দূরের কথা, তিন বেলা খাবার দেয়া সম্ভব ছিল না।   আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছেন বহুদিন। লজ্জায় কারও কাছে কিছু বলতে পারেননি। কোনো উপায় না পেয়ে সন্তানদের নিয়ে ফিরে যায় বাবার বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের খাবার জোগাতে একপর্যায়ে উপজেলার ফকির বাড়িতে অবস্থিত ভাই ভাই স্পিনিং মিলে কাজ নেন তিনি। মাস কয়েক সেখানে কাজ করে রোজগার যা হতো তা দিয়েই কোনো মতে চলত তিন সদস্যের ছোট পরিবারটি। পরে বেশ কয়েক মাস স্থানীয় সরকারের আওতায় একটি প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করেছেন। ছেলেমেয়ের অসুখবিসুখ হলে চিকিৎসা করাতে পারত না। হঠাৎ একদিন লোক মারফত জানতে পারে যুব উন্নয়ন অধিদফতরে হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পরে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাঠ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ নিয়েও পুঁজির অভাবে খামার চালু করতে পারছিল না সে। অবশেষে বাবার দেয়া কানের দুল বিক্রি করে ৯ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১১ সালে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খামার। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত ছোট ঘরে প্রথমে তিনি একদিন বয়সের ২০০টি ব্রয়লার বাচ্চা তার খামারে তোলেন। প্রথমবার মুরগি বিক্রি করে লাভও হয় ভালো। দ্বিতীয় দফায় তার খামারে ৩০০টি বাচ্চা তোলেন। হঠাৎ মুরগির খামারটিতে মড়ক লেগে মুরগিগুলো মারা যায়। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে যান তিনি।  পরে তার খামারটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথটিও। নানাভাবে চেষ্টা করেও খামারটি পুনরায় চালু করতে পারছিলেন না। তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। পরে তিনি প্রশিকা (এনজিওথেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। সামান্য টাকায় খামারটি পুনরায় চালু করতে পারছিলেন না। তিনি যোগাযোগ করেন আড়াইহাজার সদর বাজারের রাফসান পোলট্রি ফিড নামে একটি খাবার বিক্রেতার সঙ্গে। ওই ব্যবসায়ী তাকে ব্যবসা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। খাবারের দোকানের মালিক মাহবুব মিয়া জানান, মাহমুদা একজন পরিশ্রমী নারী। তাকে আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। কঠোর পরিশ্রমই তাকে সফলতার মুখ দেখিয়েছে। অন্য আর ১০টি খামারি থেকে তিনি ভিন্ন। সফলতার দিক দিয়ে তিনি বেশ এগিয়েছেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি সবার কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। মনোবল আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে এগিয়ে দিয়েছে। পোলট্রি ব্যবসা করে তার দিন বদলেছে। মাহমুদা বলেন, বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে তিনি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুরগির খামার করে আমি আমার পোলা-মাইয়া লইয়া অহন অনেক সুখে আছি, আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।’ আমার দিন বদলে গেছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়াচ্ছি। তার চেয়ে সুখী ওই গাঁয়ে আর কেউ নেই বলে তিনি দাবি করেন। এ ছাড়াও তিনি বাড়ির পাশে একটি পুকুর ভাড়ায় নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করছেন। সেখানেও তার মোটা অঙ্কের টাকা লাভ হচ্ছে। এক সময় অন্যের ঘরে থাকলেও টাকা জমিয়ে থাকার জন্য পিঁড়া পাকা করে দোচালা একটি টিনের ঘর দিয়েছি। ছেলেমেয়েদের ভালো খেতে দিতে পারছি। এখন এলাকায় বিভিন্ন খামরি আমার কাছ থেকে মুরগি পালন বিষয়ে নানা পরামর্শ নিতে আসে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধের ব্যাপারে এলাকায় সচেতনমূলক কাজ করছেন। এ ব্যবসার পাশাপাশি তিনি এলাকায় সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে তার খামারে ব্রয়লার মুরগির সংখ্যা এক হাজার। ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি তিনি একটি লেয়ার খামার গড়ে তুলার চেষ্টা করছেন। তার সফলতা দেখে ওই গ্রামের অনেকেই পোলট্রি ব্যবসা করতে শুরু করছে।
মুরগির খামার বদলে দিল রাশিদার জীবন
নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের বাসিন্দা রাশিদা। বৈবাহিক জীবনে দুই সন্তানের জননী তিনি। কিন্তু রিকশাচালক স্বামী লুৎফর মিয়াকে তিন বেলা খাবার জোগান দিতে গিয়ে উন্নয়নের পথ থেকে অনেকটা ছিটকে পড়তে হয়। পাশের বাড়ির এক এনজিওকর্মীর পরামর্শে রাশিদা মুরগির ফার্ম দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। স্বামীর সহযোগিতা নিয়ে এলাকার এক স্বর্ণের দোকান থেকে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি এ ফার্মের কাজ শুরু করেন। একে একে তিনি ৫টি শেডের মাধ্যমে মুরগি পালন করতে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের যে লাভ হতো তা দিয়ে তাদের সংসার বেশ ভালোভাবে চলছিল। নিজের নামে ব্র্যাক ব্যাংক টাকা সঞ্চয়ও করছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে তার স্বামী লুৎফর সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারান। এরপর স্বামীর সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন রাশিদা। দুই সন্তান-স্বামীসহ চারজনের পরিবার একাই সামাল দিতে হয় রাশিদাকে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও জীবনের এত বড় বিপর্যয় রাশিদাকে তার লক্ষ্য থেকে পিছপা করেনি। কোমর বেঁধে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালান রাশিদা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আওতায় রাশিদা ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন, যা দিয়ে তার সংসারের অভাব ঘোচানোর স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি ২৫০টি মুরগির বাচ্চা ও বাচ্চার খাবার এবং ওষুধ কেনেন। এরপর রাশিদাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সর্বশেষ তিনি ২০১২ সালের এপ্রিলে আশা থেকে বাইশ হাজার টাকা এবং তাদের জমানো টাকা দিয়ে খামারের পরিধি বাড়ান। এখন তার তিনটি শেডে বিভিন্ন সাইজের ১৬০০ মুরগি আছে। তাদের সংসারে এখন আর কোনো আভাব নেই। ছেলেমেয়ে, স্বামী নিয়ে তার সংসার এখন ভালোই চলছে। রাশিদার দেখাদেখি অনেকে ঋণ নিয়ে নার্সারি, হাঁস-ুরগি পালন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।


সংগৃহীত ও সংকলিত
 

তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প

সেমাই তৈরি ব্যবসা

সেমাই খুবই সুস্বাদু একটি খাবার। ছোটবড় সবাই সেমাই খেতে পছন্দ করে। আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ঘরে ঘরে সেমাই রান্না করতে দেখা যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবে খাবার হিসেবে সেমাই-এর ব্যবহার রয়েছে। গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই ছোটবড় সবার কাছে সেমাই-এর কদর রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে উন্নতমানের সেমাই তৈরি হচ্ছে এবং এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব হচ্ছে।
সেমাই খুবই সুস্বাদু একটি খাবার। ছোট বড় সবাই সেমাই খেতে পছন্দ করেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ঘরে ঘরে সেমাই রান্না করতে দেখা যায়। সেমাই তৈরি ব্যবসার মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।
বাজার সম্ভাবনা
উপমহাদেশে সেমাই খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবে খাবার হিসেবে সেমাই এর ব্যবহার রয়েছে। গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই ছোট বড় সবার কাছে সেমাই এর কদর রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে উন্নত মানের সেমাই তৈরি হচ্ছে এবং এগুলো বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব হচ্ছে।
মূলধন
আনুমানিক ২২০০০-২৫০০০ টাকা মূলধন নিয়ে সেমাই তৈরির ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। সেমাই তৈরির ব্যবসা শুরু করার জন্য যদি প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকে তবে ঋণদানকারী ব্যাংক (সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক) বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) থেকে শর্ত সাপেক্ষে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ ব্যবসায় ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ
সেমাই তৈরি শেখার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেবার প্রয়োজন নেই। তবে এ ব্যবসার সাথে জড়িত এমন কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে ধারণা নেওয়া যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় উপকরণপরিমাণমূল্য ও প্রাপ্তিস্থান
স্থায়ী উপকরণ 
উপকরণ
পরিমাণ
আনুমানিক মূল্য (টাকা)
প্রাপ্তিস্থান
সেমাই মেশিন
১টি
১৮০০০-২০০০০
যন্ত্রপাতি বিক্রির দোকান
ফিতা/ বেল্ট
১টি
২০০-২১০
হার্ডওয়ারের দোকান
চাকতি
৩টি
২৯০-৩০০
হার্ডওয়ারের দোকান
বিয়ারিং
২টি
৩৫০-৩৬০
হার্ডওয়ারের দোকান
ড্রাম
১টি
৪৫০-৪৬০
হার্ডওয়ারের দোকান
মগ
২টি
৩০-৩৫
তৈজসপত্রের দোকান
বস্তা (বায়ুনিরোধক)
৫টি
৫০-৬০
হার্ডওয়ারের দোকান
মোট খরচ=১৯৩২০-২১৩৬৫ টাকা
কাঁচামাল 
উপকরণ
 পরিমাণ 
আনুমানিক মূল্য (টাকা)
প্রাপ্তিস্থান
ময়দা
৫০ কেজি
১৪৫০-১৫০০
গম ভাঙ্গিয়ে ময়দা তৈরি
জাফরং
২৫০ গ্রাম
২০-২৫
মুদি দোকান
পানি
পরিমাণমত
----------
-------
মোট খরচ=১৪৭০-১৫২৫ টাকা
সেমাই তৈরির নিয়ম
১ম ধাপ
বড় একটি পাত্রে নিদির্ষ্ট পরিমাণ ময়দা নিয়ে এর সাথে জাফরং মিশাতে হবে এবং এবার পরিমাণমত পানি মিশিয়ে মাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি নরম হয়ে না যায়।
২য় ধাপ
পানি মিশানোর পর খামির ভালভাবে মাখাতে হবে যেন কোথাও ময়দার দলা না থাকে। মাখানো শেষ হলে মেশিনের মধ্যে খামির ঢেলে মেশিন চালাতে হবে, এর ফলে মেশিনের চাকতি দিয়ে চিকন চিকন ময়দা বের হবে।
৩য় ধাপ
বের হওয়া সেমাই লম্বা লম্বা করে কেটে রোদে শুকাতে দিতে হবে। সেমাই শুকানোর পর তা নিদির্ষ্ট পরিমাণ মেপে মেপে প্যাকেটজাত করতে হবে।
আনুমানিক আয় ও লাভের পরিমাণ
খরচ  
স্থায়ী যন্ত্রপাতির অবচয় (ক্ষতি) বাবদ
৩০-৩৫ টাকা
কাঁচামাল ক্রয় বাবদ খরচ
১৪৭০-১৫২৫ টাকা
প্যাকেজিং বাবদ খরচ
১৮০-২০০ টাকা
অন্যান্য বাবদ খরচ
৯০-১০০ টাকা
মোট খরচ=১৭৭০-১৮৬০টাকা

আয় 
৫০ কেজি ময়দা থেকে প্রায় ৭০ কেজি সেমাই তৈরি করা সম্ভব। 
১ কেজি সেমাই বিক্রিতে আয়=৩৮-৪০ টাকা
৭০ কেজি সেমাই বিক্রিতে আয়=২৬৬০-২৮০০ টাকা

লাভ 
৭০ কেজি সেমাই বিক্রিতে আয়
২৬৬০-২৮০০ টাকা
৭০ কেজি সেমাই তৈরিতে খরচ
১৭৭০-১৮৬০ টাকা
লাভ=৮৯০-৯৪০ টাকা
অর্থাৎ ৮৯০-৯৪০ টাকা লাভ করা সম্ভব। তবে সময়ভেদে লাভের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে
স্থায়ী উপকরণগুলো একবার কিনলে অনেকদিন ধরে কাজ করা যাবে। ব্যবসার শুরুতেই এ খরচটি করতে পারলে পরবর্তীতে শুধু কাঁচামাল কিনে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।
তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প

স্কুলব্যাগ তৈরী

সম্ভাব্য পুঁজি:        
৫০০০০ টাকা থেকে ১০০০০০ টাকা পর্যন্ত
সম্ভাব্য লাভ:        
৬০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।
যা প্রয়োজন:        
সেলাই মেশিন, হাতুড়ি, কাঁচি, নানা রকম কাপড়, সুতা, চেইন, স্টিকার, বকলেস, আইলেস, ফিতা ইত্যাদি।
প্রস্তুত প্রণালি:       
কাপড় কেটে মেশিনের সাহায্যে সেলাই করে নানা রকম ডিজাইনের ব্যাগ তৈরি করা হয়ে থাকে। আকর্ষণীয় করতে ব্যাগে নানা ডিজাইন আনা হয়। এজন্য স্টিকার, বকলেস, আইলেস, ফিতার ব্যবহার করা হয়।
বাজারজাতকরণ:   
ছাত্রছাত্রীরা মূলত এর ক্রেতা হলেও এখন সব শ্রেণীর মানুষই এই ব্যাগ ব্যবহার করে থাকে। চাহিদা তাই বেশি। যেকোনো শপিং মল, স্টেশনারি দোকান সর্বত্রই এর চাহিদা।
তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প

ব্যানার ও সাইনবোর্ডের দোকান

ব্যানার হলো কাপড়ে লেখা বিভিন্ন তথ্য এবং সাইনবোর্ড হলো কাপড় ও স্টীল বা টিনের উপর লেখা বিভিন্ন তথ্য যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিভিন্ন বিষয় জানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পণ্যের প্রচার-প্রচারণায় ব্যানার ও সাইনবোর্ড প্রয়োজনীয় মাধ্যম হতে পারে। আমাদের দেশে সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা, মিছিল, বনভোজনে ব্যানার ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিভিন্ন সামগ্রীর প্রচার ও বিভিন্ন তথ্য জনগণকে জানানোর জন্যও ব্যানার ব্যবহার করা হয়। ব্যানার মূলত স্বল্প সময়ের অধিবেশন ও স্বল্পকালীন তথ্য প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই ব্যানার কাপড়ের উপর বিভিন্ন রঙ দিয়ে লেখা হয়।
সাইনবোর্ড সাধারণত দোকান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, দোকান প্রভৃতির সামনে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রাস্তার পাশে বিভিন্ন নির্দেশ ও নানান দীর্ঘমেয়াদী বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সাইনবোর্ড  ব্যবহার করা হয়। সাইনবোর্ড সাধারণত বেশি সময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। এ কারণে সাইনবোর্ডে লেখার জন্য অ্যালুমিনিয়াম, টিন, স্টীল বা কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বাজার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সব স্থানেই নানান তথ্য প্রচারের জন্য সাইনবোর্ড ও ব্যানার ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ব্যানার ও সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপন এঁকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তাই সবসময় সবখানে ব্যানার ও সাইনবোর্ডের চাহিদা আছে।
স্থান নির্বাচন
ব্যানার ও সাইনবোর্ডের ব্যবসার জন্য স্থায়ী দোকান ঘরের প্রয়োজন হয়। বাজারের কেন্দ্র বা যেখানে লোক সমাগম বেশি হয় এরকম স্থানে দোকান ঘর নিলে সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।
মূলধন
ব্যানার ও সাইনবোর্ডের ব্যবসা করার জন্য স্থায়ী উপকরণ কিনতে প্রায় ২১২-২৪৫ টাকার প্রয়োজন হয়। এছাড়া ১টা ব্যানার তৈরি করতে প্রায় ১২৫-১৪১ টাকার প্রয়োজন হবে। সেই হিসেবে কাজ বুঝে কাঁচামাল কিনতে হবে। এছাড়া এই ব্যবসার জন্য স্থায়ী দোকানের প্রয়োজন। তাই দোকান ঘরের পজিশন ও ভাড়া বাবদ আলাদা টাকার প্রয়োজন হবে। যদি ব্যক্তিগত পূঁজি না থাকে তাহলে মূলধন সংগ্রহের জন্য নিকট আত্মীয়স্বজন, ঋণদানকারী ব্যাংক(সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক , রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক)বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) -এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ
ব্যানার ও সাইনবোর্ডের ব্যবসা শুরু করার আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে ব্যবসার বিস্তারিত জেনে নিলে ভালো। এই ব্যবসা করতে হলে কিছুটা লেখাপড়া জানতে হয়। এছাড়া উদ্যোক্তাকে সৃজনশীল হতে হবে। সুন্দর হাতের লেখা এবং একটু নতুন আঙ্গিকে ব্যানার ও সাইনবোর্ড লিখলে সহজেই বাজারে সুনাম ছড়াবে এবং বেশি অর্ডার পাওয়া যাবে।
প্রয়োজনীয় উপকরণপরিমাণমূল্য ও প্রাপ্তিস্থান
স্থায়ী উপকরণ 
উপকরণ
পরিমাণ
 আনুমানিক মূল্য (টাকা) 
প্রাপ্তিস্থান
হাতুড়ি
১টা
৮০-১০০
হার্ডওয়ারের দোকান
স্কেল
১টা
২২-২৫
স্টেশনারি দোকান
তুলি
২/৩টা
৯০-৯৫
হার্ডওয়ারের দোকান
রঙ মেশানোর পাত্র
২টা
২০-২৫
তৈজসপত্রের দোকান
মোট=২১২-২৪৫ টাকা 

কাঁচামাল (১টি ব্যানার লেখার জন্য)
উপকরণ
পরিমাণ
 আনুমানিক মূল্য (টাকা) 
প্রাপ্তিস্থান
কাপড়
৪ গজ
৮০-৮৫
কাপড়ের দোকান
রঙ( প্লাস্টিক পেইন্ট)
পরিমাণ মত
৩৫-৪০
হার্ডওয়ারের দোকান
চক
১টা
৫-৮
স্টেশনারি দোকান
পেন্সিল
১টা
৫-৮
স্টেশনারি দোকান
মোট=১২৫-১৪১ টাকা
ব্যানার তৈরির নিয়ম
সাধারণত ব্যানার তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অর্ডারের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে নিদের্শকারীর পছন্দ অনুযায়ী ব্যানারের কাপড় ও রঙ নির্বাচন করা হয়। ব্যানারের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মাপও হয় তাদের নিদের্শ অনুযায়ী।
ব্যানার তৈরির বিভিন্ন ধাপ
  • প্রথমে ব্যানার ক্রেতার নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক মাপ, রঙ ও ধরণ অনুযায়ী কাপড় নিতে হবে।
  • এর পর ব্যানারে যে বিষয়টি লেখা হবে সেটা লেখার জন্য কাপড়ের উপর চক ও স্কেল এর সাহায্যে দাগ দিয়ে নিতে হবে। এটা করা হয় যাতে সব লেখাগুলো একই মাপের হয়। সাধারণত সবচেয়ে জরুরি তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নাম বা সম্মেলন বা সভার প্রধান ব্যক্তির নাম অপেক্ষাকৃত বড় অক্ষরে লেখা হয়। সেদিকে খেয়াল করে সেই মাপ অনুযায়ী কাপড়ে দাগ দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতার নির্দেশনা থাকলে তা মেনে চলতে হবে।
  • এরপর দাগের মধ্যে যে তথ্য দেওয়া হবে সেটা লিখতে হবে। লেখাটা প্রথমে চক দিয়ে লিখে নেওয়া ভালো। কারণ এক্ষেত্রে কোন ভুল হলে তা সংশোধন করার উপায় থাকবে।
  • লেখা শেষ হলে যে রঙ দিয়ে ব্যানারের উপর লেখা হবে সেই রঙ একটি পাত্রে ভালোভাবে গুলিয়ে নিতে হবে।
  • ব্যানারটা সমান মেঝেতে রেখে বা সমান দেয়ালে টাঙিয়ে আগে যা চক দিয়ে লেখা হয়েছে তার উপর রঙ ও তুলির সাহায্যে লিখতে হবে।
  • লেখা শেষ হলে রঙ শুকানোর জন্য ব্যানারটা কিছুক্ষণ বাতাসে রাখতে হবে।
  • ক্রেতা যদি ব্যানারটা ফ্রেমে আটকানো অবস্থায় চায়, তাহলে ব্যানারের মাপ অনুযায়ী কাঠ কেটে নিয়ে একটি ফ্রেম তৈরি করতে হবে। ব্যানারটিকে ফ্রেমের উপর রেখে এর চারপাশে পেরেক ও হাতুড়ির মাধ্যমে আটকিয়ে দিতে হবে।
সাইনবোর্ড তৈরির নিয়ম
সাইনবোর্ড ঠিক ব্যানারের নিয়মেই লেখা হয়। তবে এক্ষেত্রে কাপড়ের পরিবর্তে টিন, স্টীল বা কাঠ ব্যবহার করা হয় এবং এনামেল রঙ ব্যবহার করা হয়। অনেকসময় স্টীল বা টিনটাকে বিভিন্ন রঙে রঙিন করে নিয়ে তার উপর লেখা হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে মাপ মতো টিন বা স্টীল নিয়ে সেটাকে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী রঙে রঙিন করে নিতে হবে। রঙ করা শেষ হলে এটা ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে তার উপর ব্যানার যে নিয়মে লেখা হয় সেভাবে রঙয়ের টিন বা স্টীলে লেখার কাজ শুরু করতে হবে।
সাবধানতা
  • ব্যানার ও সাইনবোর্ডের রঙ যাতে ভালোভাবে শুকায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • সুন্দর ও পরিস্কার হাতের লেখা হলে ব্যানারটা দেখতে সুন্দর হবে।  
  • রঙ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে ব্যানার বা সাইনবোর্ড ভালো হবে না।
     
আয় ও লাভের হিসাব
নির্দেশ অনুযায়ী ব্যানার ও সাইনবোর্ড তৈরি করে তার বিনিময়ে ব্যানার তৈরির খরচ ও মজুরি নেয়া যাবে।
মোট খরচ 
খরচের ক্ষেত্র
আনুমানিক খরচ (টাকা)
১টা ব্যানার লিখতে কাঁচামালের খরচ
১২৫-১৪১ টাকা
মজুরি
৮০-৯০ টাকা
স্থায়ী উপকরণের অবচয়  (ক্ষতি) বাবদ খরচ
১০-১৫ টাকা
একটি ব্যানার তৈরি করতে মোট খরচ ২১৫-২৪৬ টাকা
আয় ও লাভের পরিমাণ 
১টি ব্যানারের মজুরিসহ মূল্য
৩৪০-৩৫০ টাকা
১টা ব্যানার লিখতে মোট খরচ
২১৫-২৪৬ টাকা
একটি ব্যানার তৈরি করে মোট লাভ= ১২৫-১০৪ টাকা
এছাড়া বিনিয়োগ ও বিক্রয়ের উপর আয় ও লাভ-ক্ষতি নির্ভর করে। অনেক সময় জিনিসপত্রের দাম উঠানামা করে। তাই এ ক্ষেত্রে হিসাব শুধুমাত্র ধারণা দেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।
স্থায়ী উপকরণগুলো একবার কিনলে অনেকদিন ধরে কাজ করা যাবে। ব্যবসার শুরুতেই এ খরচটি করতে পারলে পরবর্তীতে শুধু কাঁচামাল কিনে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।
তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প

মোমবাতি তৈরি ব্যবসা

দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে মোমবাতি অন্যতম। অল্প খরচের মধ্যে আলো পেতে মোমবাতি খুবই উপকারি পণ্য। কাঁচামাল হিসেবে প্যারাফিন ব্যবহার করে খুব সহজে মোমবাতি তৈরি করা যায়। বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় সময়ে আলো দানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, এমনকি শো পিস হিসেবেও নানা রঙ ও আকৃতির মোমবাতি ব্যবহার করা হচ্ছে।  একজন বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থানের জন্য মোমবাতি তৈরির ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
বাজার সম্ভাবনা
গ্রাম বা শহর সব জায়গার মানুষ মোমবাতির ব্যবহার করে। মোমবাতি তৈরি করে নিজ এলাকা বা এলাকার বাইরে মুদি দোকান গুলোতে পাইকারী দরে বিক্রি করা যেতে পারে। সাধারণত বিভিন্ন আকৃতির নকশা করা নানা রঙের মোমবাতির চাহিদা মূলত: শহরেই বেশি দেখা যায়। এ জাতীয় মোমবাতি শহরের সৌখিন পণ্য বিক্রির দোকানে সরবরাহ করা যেতে পারে।
 
স্বল্প সুদে ঋণ:
আনুমানিক ৭৫০০-৮০০০ টাকার স্থায়ী উপকরণ এবং ৮০০-১০০০ টাকার কাঁচামাল কিনে মোমবাতি তৈরির ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন নিজের কাছে না থাকলে স্থানীয় ঋণদানকারী ব্যাংক (সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক)বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) থেকে শর্ত সাপেক্ষে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া যেতে পারে।
প্রশিক্ষণ
প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মোমবাতি তৈরীতে অভিজ্ঞ এমন কোন ব্যক্তি, স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক), যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
দরকারি জিনিসপত্র
স্হায়ী কাঁচামাল এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে কাচামালের আনুমানিক দাম (টাকায়)
  • ডাইস * মোমবাতি তরির কারখানায় * ৭,৫০০.০০
  • কড়াই * থালা-বাটির দোকানে ১২০.০০
  • পাত্র * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
  • ছুরি * থালা-বাটির দোকানে ২৫.০০
  • কাঁচি * থালা-বাটির দোকানে ৫০.০০
  • চামচ * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
  • মগ * থালা-বাটির দোকানে ১০.০০
  • বালতি * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
  • তুলি * রঙের দোকানে ২০.০০
  • স্টোভ * থালা-বাটির দোকানে ১০০.০০
  • মোট = ৮,০০৫.০০
প্রথম ধাপ
মোম তৈরির ডাইস বা ছাঁচের দুটি অংশ একটি ছিঁটকিনি দিয়ে আটাকানো থাকে। এবং ডাইসের ভিতরে মোমবাতি আকৃতির কতগুলো খাঁজ থাকে। প্রথমে ডাইসের ছিটকিনি খুলে ছাঁচের দুইটি অংশ আলাদা করতে হবে। এরপর একটি কাপড়ে তেল নিয়ে ডাইসের ভিতরে থাকা খাঁজগুলো ভালো ভাবে মুছে নিতে হবে, যাতে করে  মোমগুলো খুব সহজে বের করা যায়।
দ্বিতীয় ধাপ
ছাঁচের মধ্যে সলতে পরানোর জায়গা রয়েছে। সলতেগুলো উপর থেকে নিচ পর্যন্ত টান টান করে বেঁধে দিতে হবে।
তৃতীয় ধাপ
এরপর ছাঁচের ২টি অংশ এক সাথে আটঁকে দিতে হবে এবং ছাঁচের সাথে লাগানো পানির ট্যাংকে পানি ভরতে হবে। কারণ পানি ভরা থাকলে গরম মোম ঠান্ডা হতে সহজ হয়।
চতুর্থ ধাপ
এবার চুলায় কড়াই বসাতে হবে। কড়াই গরম হলে তার মধ্যে সাদা শক্ত মোম (প্যারাফিন) দিতে  হবে। মোম পুরোপুরি গলে যাবার আগেই কড়াইতে ১০ ভাগ মোমের সাথে ১ ভাগ স্টিয়ারিক এসিড মিশাতে হবে।
পঞ্চম ধাপ
প্যারাফিন গলে যাবার পর বেশিক্ষণ চুলায় রাখা যাবে না। কারণ গলে যাওয়া প্যারাফিন বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে পারে।
ষষ্ঠ ধাপ
গলা মোম মগে বা চামচে করে আস্তে আস্তে মেশিনের খাঁজগুলোতে ঢালতে হবে।
সপ্তম ধাপ
মোম ঢালার খাঁজটি যতক্ষণ না পুরোপুরিভাবে ভরবে ততক্ষণ পর্যন্ত মোম ঢালতে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মোম ঢালার সময় খাঁজের ভেতরে যেন কোন ফাঁকা থেকে না যায়।
অষ্টম ধাপ
২০২৫ মিনিট পর মোমগুলো ঠান্ডা হলে ছাঁচের ২টি অংশ আলাদা করে মোমগুলো বের করে আনতে হবে
নবম ধাপ
এবার মোমের সলতের বাড়তি অংশগুলো সাইজ মত কাটতে হবে এবং মোমবাতি ভালোভাবে বসানোর জন্য নিচের অংশের তলাটি সমান করে কাটতে হবে। বিভিন্ন আকৃতির নকশা করা মোম তৈরির জন্য সেই অনুযায়ী ছাঁচ তৈরি করতে হয়।
সাবধানতা
  • মোমবাতি তৈরি করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে-
  • স্টিয়ারিক এসিড মোমের সাথে মেশানোর সময় সাবধান থাকতে হবে।
  • মোমে যদি আগুন ধরে যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে চুলা নিভিয়ে ঢাকনা দিয়ে কড়াই ঢেকে দিতে হবে।
  • চুলার উপর কড়াই থাকা অবস্থায় রং মেশানো যাবে না, চুলা থেকে নামিয়ে রং মেশাতে হবে।
  • মোম তৈরির কাচামাল থেকে ও তৈরির সময় শিশুদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে।
  • কাজ শেষে মোমের ছাঁচটি পরিস্কার করে রাখলে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
কাঁচামালের খরচ
  • কাঁচামাল পরিমাণ দাম (টাকায়)
  • সাদমোম ১০০০০ গ্রাম ৫০০.০০
  • ইস্টারিক এসিড ১০০০ গ্রাম ৫৫.০০
  • সুতা ২৫০ গ্রাম ১৮.০০
  • রং ৫০০ গ্রাম ৭.০০
  • সয়াবিন ৫০ গ্রাম ২.০০
  • প্যাকেট ২৫ টি ২৫.০০
  • লেবেল ২৫ টি ২.৫০
  • আঠা আনুমানিক ৫.০০
  • মোট = ৬১৪.৫০
সবসময়ের জন্য দরকারি জিনিসপত্রের খরচ
  • জিনিসপত্র পরিমাণ দাম (টাকায়)
  • ডাইস ১ টা ৭৫০০.০০
  • কড়াই ২ টা ১২০.০০
  • পাত্র ২ টা ৬০.০০
  • ছুরি ১ টা ২৫.০০
  • কাচি ১ টা ৫০.০০
  • চামচ ৩ টা ১টা বড়, ২টা ছোট) ৬০.০০
  • মগ ১ টা ১০.০০
  • বালতি ১ টা ৬০.০০
  • কৌটা ৪ টা (ছোট) ২০.০০
  • স্টোভ ১ টা ১০০.০০
  • মোট = ৮,০০৫.০০
অন্যান্য খরচ
  • খরচের খাত টাকার পরিমাণ
  • যাতায়াত (কাঁচামাল ও জিনিসপত্র কেনা ও মোমবাতি বেচার জন্য) ১০০
  • জ্বালানি (কেরোসিন)-১ কেজি ২০
  • মজুরি-১ দিন ৬০
  • মোট =১৮০
৩টি খাতের মোট খরচ
খরচের খাত টাকার পরিমাণ
  • কাঁচামাল ৬১৪.৫০
  • স্হায়ী খরচ (মোট খরচের ০.০৫%) ৪.০০
  • অন্যান্য খরচ ১৮০.০০
  • মোট =৭৯৮.৫০
উপরের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে   ৯৮.৫০ টাকা খরচ করে ৫.০০ টাকা দামের ২৫০টি মোম উৎপাদন করা যাবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি মোম ৪০০ টাকা দরে দোকানে বেচা যাবে। এই দরে বেচলে ২৫০টি মোমের মোট দাম পাওয়া যাবে ১০০০ টাকা। এই হিসাব থেকে সহজেই প্রকৃত লাভ বের করা যায়। যেমন-
২৫০ টি মোম দোকানে বেচে পাওয়া যাবে ১০০০.০০ টাকা
২৫০ টি মোম তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৭৯৮.৫০ টাকা
প্রকৃত লাভ =২০১.৫০ টাকা
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১দিনে ২৫০টি মোমবাতি তৈরি করে বেচার পর ২০১৫০ টাকা লাভ করা যেতে পারে। এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাজার দরের ভিত্তিতে আয়-ব্যযের হিসাব বের করা হলো। কিন্তু কাঁচামাল ও জিনিসপত্রের দাম প্রায়ই ওঠানামা করে তাই এই হিসাবটি কম বা বেশি হতে পারে।
সুতরাং বলা যায় যে, অন্যান্য অকৃষি উদ্যোগের মতই মোমবাতি তৈরি এখনও বেঁচে থাকার একটি ভালো উপায় হিসেবে অনেক দরিদ্র মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য। তাই আজকের বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য এমনকি পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সংস্হান করার একটি উতকৃষ্ট উপায় হতে পারে মোমবাতি তৈরি করে বিক্রি করা।
কেস স্টাডি:
মোমে আলোকিত ফারজানা
অভাবের তাড়নায় অনেকটা বাধ্য হয়েই ফারজানা একদিন শুরু করেছিল মোমবাতি তৈরির কাজ। রাত-দিন কাজ করেছে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের আশায়। তার পরের গল্পটা অন্যরকম। মোমবাতি তৈরি করেই সংসারের অভাব দূর করেছে ফারজানা। মোমের আলোর মতোই এখন সুখের আলো ছড়িয়ে পড়ছে মিরপুর পল্লবীর মিল্লাত ক্যাম্পের ফারজানার ঘরে। ফারজানা এখন মোমের আলোয় আলোকিত। ফারজানা জানায়, ‘মায়ের মায়া ভরা মুখ খুব একটা মনে পড়ে না। তবে মা’র আদর এখনও অনুভব করি। আমার পাঁচ বছর বয়সে একদিন হঠাৎ করেই মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু মন এখনও পেতে চায় মায়ের আঁচলের তলায় নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মা ঘরে আসার পর শুরু হয় অশান্তি।’ স্কুল কী ফারজানা জানে না। অনাদর আর অবহেলায় দিন কেটে যায়। যে বয়সে খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে অভাব আর পারিবারিক প্রয়োজনে সম্পৃক্ত হয়েছিল কাজের বাঁধনে। ৭ বছর বয়স খেকেই ফারজানা একটি গুল তৈরির কারখানায় গুলের কৌটায় লেবেল লাগানোর কাজ শুরু করে। কাজ করে যে টাকা পেত, তা সব সৎ মা’র হাতে এনে দিতে হতো। দিনে দিনে সুন্দর কোমলমতি শিশু ফারজানা বেড়ে ওঠে, সুন্দর তরুণী হিসেবে নজর কাড়ে এলাকার সবার। ১২ বছর বয়সেই প্রতিবেশী আবুল কালাম পছন্দ করে বিয়ে করে তাকে। তার পর শুরু হয় আরেক দুঃখের গল্প। টিএমএসএস সূত্রে জানা যায়, মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রতিবেশী কালামের সঙ্গে ফারজানার বিয়ে হয়। ছোটবেলা থেকে অভাব আর গঞ্জনার মাঝে বেড়ে ওঠা ফারজানা বিয়ের পর ভেবে ছিল, অভাব আর অশান্তির দুনিয়া থেকে রেহাই পেল। কিন্তু না, কালাম ছিল কর্মবিমুখ, আড্ডাবাজ যুবক। যার ফলে সংসারে দেখা দেয় অভাব। অভাবের তাড়নায় এক সময় বাধ্য হয়ে ফারজানার স্বামী কালাম একটি মোমবাতি তৈরি কারখানায় কাজ নেয়। মাঝে-মধ্যে বাড়তি কাজ বাড়িতে নিয়ে আসে। বুদ্ধিমতি ফারজানা স্বামীর মোমবাতি তৈরি করা খুব মনোযোগ সহকারে দেখত। দেখে দেখেই একদিন ফারজানা মোমবাতি বানানো শিখে যায়। কাজ শিখে ফারজানা নিজেই একটা কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ফারজানা জানে, অন্যের কারখানায় হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তেমন একটা লাভ হয় না।এদিকে ফারজানা-কালামের সংসারে নতুন অতিথির আগমন ঘটে। ফারজানার কোলজুড়ে আসে এক মেয়ে সন্তান। সন্তানের আগমনও তার জন্য বাড়তি খরচ হয়ে দেখা দেয়। এ অবস্থায় কী করা যায়, এই ভেবে দু’জনেই দিশেহারা। ভাবনার এক পর্যায়ে এক প্রতিবেশী খবর দেয় এলাকার একটি সমিতির, যার নাম ‘মিল্লাত ক্যাম্প শ্রমজীবী মহিলা শক্তি’ সমিতির অফিসের নাম টিএমএসএস। প্রতিবেশী জানায়, সমিতির অফিস গ্রুপ তৈরি করে নারীদের ঋণ দেয়, উন্নয়নমূলক আলোচনা করে। পরবর্তী সময়ে সমিতির কর্মকান্ডের খোঁজ-খবর  নিয়ে ফারজানা আর দেরি না করে সমিতির সদস্য হয়ে যায়। ২৯ আগস্ট, ২০০৬ সালে সে সমিতির সদস্য হয়। সেই সময় সমিতির সদস্য ছিল মাত্র ৬ জন। এ অবস্থাতেই ফারজানা টিএমএসএস থেকে ঋণ নিয়ে মোমবাতি তৈরির কাজ শুরু করে। তারপর মিল্লাত ক্যাম্প, ১১/বি, পল্লবী, মিরপুর ১ এই ঠিকানায় ফারজানা গড়ে তোলে নিজের আবাস। শুরু হয় ফারজানার স্বপ্ন দেখা। অভাবের সংসার মোমবাতির আলোয় আলোকিত হতে শুরু করে। এবার কারখানার কাজের পাশাপাশি নিজেরাও মোমবাতি তৈরি করা শুরু করে। নিজেরাই মোম তৈরি করে পাইকারিভাবে বিক্রি করতে থাকে। প্রথম ঋণ নিয়েই কাজ শুরু করেছিল, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। দ্বিতীয়বার ঋণ নিয়ে তৈরি করে ঘরের সঙ্গে লাগানো একটি মুদি দোকান।
ফারজানার কোলজুড়ে আসতে থাকে একের পর এক নতুন অতিথি। এখন স্বামী আর চার মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সন্তানের সংখ্যা বেশি হলেও তৃপ্তির হাসি আছে ফারজানার ঠোঁটের কোণে। কারণ তার মেয়েগুলো বুদ্ধিমতি ও কর্মঠ। স্কুলেও পড়ছে, আবার অন্যের বুটিকস কারচুপির কারখানায় কাজও করে। ফারজানার স্বপ্ন, চার মেয়েকেই তার সামর্থ্য মতো লেখাপড়া শেখাবে। ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তাই করবে না। কারণ অল্প বয়সে বিয়ে হলে মা এবং সন্তান দুই জনেরই সমস্যা হয়। সে নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে শিখেছে। ফারজানা আজ আর্থিকভাবে সচ্ছল।
সমিতি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯৭ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি উঠিয়েছে ফারজানা। কোনো খেলাপি হয়নি। সঞ্চয় জমা আছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ডিপিএস আছে ২০০ টাকা করে। ফারজানা জানায়, সচেতনতা আর বুদ্ধি তেমনভাবে কাজ না করার ফলে ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই চার সন্তানের মা হয়েছি। এখনকার মতো জ্ঞান থাকলে ২ টার বেশি সন্তান নিতাম না। ফারজানা গর্বিত, স্বামী এখন তাকে আর আগের মতো অবহেলা করে না। মোমবাতি তৈরি বা মুদি দোকানের কাজ তারা দু’জনে এক সঙ্গেই করে।  ফারজানা জানায়, বিয়ের পর তাদের সংসাবে অভাব ছাড়া আর কিছুই ছিল না। টিএমএসএসের ঋণ নিয়েই ব্যবসা বড় করেছে। একটি মাত্র ঘর ছিল, আজ দুটি ঘর হয়েছে, হয়েছে পানির ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা। ফারজানার মতে, নারীদের কাজ স্বীকৃতি দেয়া দরকার, কারণ পুরুষ বা নারী সবাই সমান। নির্যাতন সম্পর্কে সে বলে, ‘আমাদের মহল্লায় নারীদের নির্যাতিত হতে দেখলে সেখানে ছুটে যাই, বোঝাতে চেষ্টা করি, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মিলেমিশে জীবনটাকে চালাতে হবে’। সেখানে তাদের সঙ্গে কথা বলি, এটা ঠিক কাজ নয়। নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।  একদিন অভাবের তাড়নায় ফারজানার যে চোখে অন্ধকার বাসা বেঁধে ছিল, মোমবাতি তৈরি করে ফারজানার সেই চোখে-মুখে আজ আলোর দীপ্তশিখা জ্বল জ্বল করছে
মোমের আলোয় আলোকিত ফাতেমার জীবন
মোমবাতি তৈরি করে অভাবের সংসারে সুখের আলো জ্বালিয়েছেন আমতলী সদর উপজেলার হলদিয়া গ্রামের ফাতেমা বেগম। ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে মোমবাতি তৈরি শুরু করে কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৫ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিনেছেন জায়গা-জমি, তৈরি করেছেন ঘরবাড়ি। করেছেন ব্যবসার প্রসার। মোমাবাতি তৈরির পাশাপাশি আগরবাতি ও চানাচুরও তৈরি করছেন। ফাতেমার কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জন মহিলার। ফাতেমা বেগমের সঙ্গে কথা কলে জানা যায়, তারা পাঁচ ভাই ও এক বোন। ৮ বছর বয়সে বাবা মারা যান। মায়ের ওপর সংসার পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার পরিচালনা করতেন। স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অসহায় মায়ের সংসারে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। মা মেয়ের চিন্তায় দুর্বল হয়ে যায়। ১৮ বছর বয়সে হলদিয়া গ্রামের মোকলেচ খলিফার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ি যান। সেখানের অবস্থাও আরও করুণ। সেখানেও শ্বশুর ছিল না। শাশুড়ি, ভাসুর ও দেবরের মধ্যে স্বামী ছিল দ্বিতীয়। শ্বশুরবাড়িও অভাবের সংসার। রাতে ঘরের ভেতর থেকে চাঁদের আলো চোখে পড়ত। এ অভাবের মধ্যে শাশুড়ি ছেলেদের আলাদা করে দেয়। স্বামীর শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলেনি। তাই কোনো উপায় না পেয়ে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চিটাগাং বড় শহরে কাজের সন্ধানে যান। সেখানে কোনো পরিচিত লোক ছিল না। স্বামী রাজ জোগালি করত। নিজে ইট ভেঙে সংসার চালাত। পলিথিন দিয়ে বাসা বানিয়ে থাকতেন। এভাবে ১৬টি বছর থাকার পরেও কোনো উন্নতি হয়নি। তাই আবার নিজ এলাকা হলদিয়া ফিরে আসেন।
বাড়ি ফেরার পর দেখেন ঘরটি উলিতে খেয়ে ফেলেছে। থাকার কোনো জায়গা নেই। তাই আবার অন্যের ঘরে চারটি বছর কেটেছে। এর মধ্যে স্বামী কামলা দিয়ে সংসার চালায়। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। তাই ভাবল এভাবে জীবন কাটানো যায় না। নিজের কিছু করা দরকার। মোম তৈরির ফ্যাক্টরিতে ১ বছর কাজ করলেন। তার পরে মনে উদয় হলো এভাবে অন্যের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে উন্নতি করা যাবে না। নিজে একটি ছোট মোম বাতি তৈরি করার মেশিন ক্রয় করবেন। মনে ইচ্ছা হলেই তো হলো না, কারণ স্বামী এ প্রস্তাবে রাজি হলো না।
আহ্ছানিয়া মিশন আমতলীর শাখা ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন জানান, এ অবস্থায় স্বামীর অজান্তে ফাতেমা বেগম বাড়ির পাশে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের দলীয় সভায় উপস্থিত হয়ে নিয়ম-কানুন জেনে নেয়। সমিতিতে গেলে মহিলারা তাকে বাঁকা চোখে দেখেন। ফাতেমা বেগমকে দলে নেয়া যাবে না, কারণ তিনি টাকার অভাবে ১৬টি বছর চিটাগাং ছিল। আবার টাকা পেলে চিটাগাং চলে যাবে। কারণ চিটাগাং একবার তিনি চিনে আসছেন।
দলের সভানেত্রী পারুল বেগম তাকে সোনার তরী দলে সদস্য করার দায়িত্ব নেন। সদস্য হওয়ার পর নিয়মত সঞ্চয় করার কিছুদিন পর ১০ হাজার টাকা মোমবাতি তৈরির জন্য ঋণ গ্রহণ করেন। তিনি ওই টাকা দিয়ে মোম তৈরির একটি মেশিন ক্রয় করেন। প্রথমে ৫ টাকা ও ১০ টাকা দামের মোম তৈরি করে ছোট ছোট বাজারে ক্ষুদ্র ও বড় দোকানে পাইকারি দেন। মোমের ব্যাপক চাহিদা তিনি দেখতে পান। উৎপাদিত মোমের সঙ্গে আগর বাতি তৈরি করার সিদ্ধান্ত করেন, সঙ্গে সঙ্গে বানাতে শুরু করে। ওই কারখানায় প্রথমে দুই-একজন মহিলা কর্মসংস্থানে সুযোগ পায় ও নিজেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয়বার ১৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসার টাকা দিয়ে সর্বমোট ৩০ হাজার টাকায় চানাচুর তৈরির ডাইস ক্রয় করেন। চানাচুর ও ঝালমুড়ি তৈরি ও প্যাকেটিং করে বাজারে পাইকারি দেন। তৃতীয়বার ২০ হাজার টাকার লোন করে এ টাকা দিয়ে চানাচুর, মটর ডাল, ঝালমুড়ি, মোমবাতি ও আগরবাতি তৈরি করে বাজারজাতকরণের সুবিধা গ্রহণ করেন। এ প্রকল্পে প্যাকেটিং করার জন্য ১০-১৫ জন মহিলার কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেন। তার ছেলে ওই উৎপাদিত মালামাল বিভিন্ন বাজারে আমতলী, চুনাখালী, কলাপাড়া, তালুকদারহাট, মহিষকাটা, গাজীপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা পাইকারি দেন।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের আর্থিক সহায়তায় মোড় ঘুরিয়ে দেন। বর্তমানে তার প্রকল্পে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূলধন রয়েছে। এ ছাড়াও দুটি গরু, যার মূল্য ৪০ হাজার টাকা এবং ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে টিনের একটি ঘর তৈরি করেছেন। বর্তমানে তার চোখেমুখে সচ্ছলতার হাসি। এক সময় যে অভাবী নারী সমাজের কাছে তুচ্ছ ছিল, তার মোমের আলোয় সমাজকে করে আলোকিত। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের আর্থিক সহায়তা দারিদ্র্যকে জয় করে সমাজের সফল নারী হিসেবে পরিচয় দিতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফাতেমা বেগম।





তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প