Pages

Thursday, 1 September 2016

একটি শিমুল গাছ





লেখক : Babul Hossain 
 খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে বড় শিমুল গাছটা। তারপর মাঠ। মাঠের পর একটা শীর্ণ নদী পরপর তিনটি বাঁক নিয়ে চলে গেছে সোঁজা দিগন্ত বরাবর। জানালার পাশের এ শিমুল গাছটা হতে, দূরের ঐ দিগন্ত পর্যন্ত যে আকাশটুকু দেখা যায়, তাতে নানা বৈচিত্র খেলা করে। ভিন্ন-ভিন্ন মৌসুমে, ভিন্ন-ভিন্ন দৃশ্যের উপস্থাপনা সেখানে। অন্তুর কাছে আকাশটাকে মনে হয় বিশাল একটা টেলিভিশনের মত। মনে হয় যেন সেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দৃশ্যের সরাসরি সম্প্রচার চলছে। ওর চোখটা আবার ফিরে আসে শিমুল গাছটার উপর। বেশ কদিন হল, শিমুল গাছটার মগডালে একটা চিল বাসা বেঁধেছে। এতদিন হল, অথচ মাত্র একবার ও দেখেছে চিলটাকে বাসায় এসে বসতে। কিছুক্ষণ বসেই আবার চিলটা উড়ে গিয়েছিল আকাশে। সারাদিন কোথায় কোন্ দূর আকাশে চিলটা উড়ে বেড়ায় কে জানে ! এ ঘরটা অন্তুর খুব প্রিয়। ওর শোবার বিছানাটা জানালার ঠিক পাশেই। জানালা দিয়ে ও শিমুল গাছ দেখে। মাঠ দেখে। মাঠের মানুষজন দেখে। ফসলের বেড়ে ওঠা দেখে। সকালে যে গবাদি পশুগুলোকে, রাখালেরা, বিশাল চকের একেবারে শেষ প্রান্তে, দিগন্ত রেখার কাছে নদীটার ধারে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যায়, সেটা যেমনি দেখে, আবার সন্ধ্যার আগে-আগে মেঠো হালটে ধুলা উড়িয়ে তাদের ঘরেও ফিরতে দেখে। সূর্য ডোবার সময় একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য রচিত হয় প্রতিদিন। 
সূর্যটা যখন পশ্চিম দিগন্তে হেলে পরে, তার লাল টকটকে আলো শীর্ণ নদীটার বাঁকগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, বিশাল মাঠ জুড়ে যেন কোন কিশোরীর চুলে বাঁধার লাল একটা ফিতা পড়ে আছে। সন্ধ্যা হলে আকাশে একটি, দুটি করে তারা জ্বলে ওঠে। রাত যখন গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায় আকাশে যেন তারার মেলা জমে। তাদের মধ্যে অনেকগুলি নক্ষত্রকে অন্তু চিনতে শিখেছে। লুব্ধক তাদের মধ্যে একটি। কালপুরুষ দেখতেও ওর খুব ভাল লাগে। অন্তু মনে-মনে হাসে। আবার তাকায় শিমুল গাছটার দিকে। আবার তাকায় শিমুল গাছটার মগডালে। যেখানে চিলটা বাসা বেঁধেছে। ও ভাবে, কেউ যদি ওর এই মুহূর্তের ভাবনাটা ধরতে পারত তবে নিশ্চয়ই পাগল ভাবত ওকে। ভরদুপুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ও রাতের নক্ষত্রের কথা ভাবছে। এমনি আজব সব ভাবনা ওর মনে আসে। শিমুল গাছে প্রচুর গুটি বের হয়েছে। কিছুদিন পরই ওগুলো ফুটে ফুল বের হবে। পাড়ার ছেলে ছোকরার দল আসবে ফুল ছিঁড়তে। আর শিশুরা যাদের ঢিল ছোঁড়ার কিংবা লম্বা লাঠি দিয়ে ফুল ছেঁড়ার সামর্থ্য হয়নি, তারা গাছের তলে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাতেই যে কি ভীষণ আনন্দ পায় ওরা, দেখতে বড় ভাল লাগে! বেশ ক-বছর আগে একবার এ শিমুল গাছটার মগডালে, যেখানে এখন বাসা বেঁধে থাকে একটি বা দুটি চিল, ঠিক ওখানে, দক্ষিণ পাড়ার সিতেশ মাঝির যুবতি বউটাকে জ্বিনেরা গভীর রাতে ঘর থেকে তুলে এনে বসিয়ে রেখেছিল। রাতভর গাছেই বসা ছিল বউটা। খুব ভোরে সবার আগে বন্দনার মা শিমুল গাছের ডালে তাকে বসে থাকতে দেখে। বন্দনার মায়ের অভ্যাস ছিল খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার। তারপর, সবার আগে পাড়া বেড়ানো। পাড়া বেড়াতে গিয়ে এ বাড়ির ফলটা, ও বাড়ির মূলটা আঁচলের তলে লুকিয়ে ঘরে ফেরা ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। জ্বিনে ধরার খবর সমস্ত গ্রামে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনা। চকবাজার ভেঙ্গে গেলে, যখন বেলা ওঠে গেল মাথার প্রায় উপরে, সিতেশ মাঝি পাড়ার কিছু সাহসী যুবককে ডেকে নিয়ে এল তার বউকে গাছ থেকে নামাতে। সঙ্গে করে নিয়ে এল বড় একখানা কাছি। আর তার পেছনে-পেছনে হই-হই করতে করতে একটা বড় মই নিয়ে এল পাড়ার উৎসাহী কিশোরের দল। লাল কাপড় পড়া সিতেশ মাঝির বউটা গাছের মগডালে বসে দিব্বি পা দোলাচ্ছিল। পান খাওয়া তার ঠোঁট দুটোকে দেখাচ্ছিল টকটকে লাল। আর কি হাসি! দেখে গায়ের লোম একেবারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আশপাশের দুচার গাঁয়ের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল অন্তুদের বাড়ি। অন্তুর বাবা গাছটা কেটেই ফেলতে চেয়েছিল। গাছটার নাকি কি দোষ আছে। কিন্তু পরে আর কাটা হয়নি। ওর বাবা আজ বেঁচে নেই। আর গাছটা, তার মগডালে আজ একটি চিল বাসা বেঁধে থাকে। 
 বাবুল হোসাইন ঢাকা,
ফেব্রুয়ারী ২০১৪

No comments:

Post a Comment